সমুদ্রের মাঝে কি সত্যিই ভুতুড়ে নগরী রয়েছে? অনেকেই হয়তো ভেবে বিস্মিত হবেন! তবে সত্যিই এমন এক নগরী রয়েছে যার নাম ‘নান মাদল। আবার সেখানে ঘুরতে যাওয়ারও ব্যবস্থা রয়েছে। আজ আমরা এমন এক ঐতিহাসিক রহস্যময় স্থান ‘নান মাদলের’ কথা জানবো।
নান মাদোল দ্বীপটি অস্ট্রেলিয়া থেকে ১৬০০ মাইল ও লস অ্যাঞ্জেলস থেকে ২৫০০ মাইল দূরে অবস্থিত। নান মাদোল শব্দের অর্থ ‘মধ্যবর্তী স্থান’। মাইক্রোনেশিয়ার পনফেই দ্বীপের গা ঘেঁষে এই দ্বীপটির অবস্থান। পনফেই দ্বীপের মানুষ নান মাদোলকে ডাকে ভূতুড়ে দ্বীপ বলে। কথিত আছে, সন্ধে ঘনালেই এই দ্বীপে নাকি অদ্ভূত সব আলোর খেলা শুরু হয়। মাঝ সমুদ্রে অবস্থিত এই নির্জন দ্বীপে রাত্রিবাস করা যায়না । অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের জন্য অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, দুপুরের মধ্যে ফিরে আসতে হবে নান মাদোল ছেড়ে। পনফেইয়ের মানুষ বলেন, অনেকেই রাতে নান মাদোলকে দেখতে গিয়েছিলেন। কেউ আর ফিরে আসেনি। কিন্তু কেন? সে প্রশ্নের কোনও জবাব নেই তাঁদের কাছে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা মনে করেন, প্রায় এক হাজার বছর আগে এখানে কোনও শহরের পত্তন করা হয়েছিল। পাথর, প্রবালে তৈরি হয়েছিল সে আশ্চর্য দ্বীপ-শহর।
গবেষকরা জানান, এই দ্বীপে ৯৭টি পাথর ঘেরা ব্লক রয়েছে। চারদিক সবুজে ঢাকা। মাঝখান দিয়ে বহমান সরু, সরু খাল। ব্লকগুলির দেওয়াল প্রায় ২৫ ফুট লম্বা, ১৭ ফুট চওড়া। কীভাবে এই ব্লকগুলি তৈরি হল তা নিয়েও কিন্তু প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে। কারণ, খুব অদ্ভূতভাবে প্রত্যেকটি ব্লক একইরকম জ্যামিতিক আকারের। মনে হবে পরিকল্পনা করে তৈরি করা। শোনা যায়, এখানে একসময় শহর ছিল। কিন্তু এমন মাঝ মহাসাগরে কেউ, কেন শহর তৈরি করবেন সে রহস্য আজও রহস্যই রয়ে গিয়েছে।
আনুমানিক ৯০০ থেকে ১৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ সময়কালীন এটি ‘সৌদিলুর রাজবংশ’-এর রাজধানী ছিলো। জায়গাটি বৃহতাকার বেসাল্ট পাথর এবং উঁচু দেয়ালের জন্য দৃষ্টি কেড়ে নেয়। ধারণা করা হয় এখানে প্রায় এক হাজার মানুষের বসবাস ছিলো। তবে সেখানে এতো দূরবর্তী একটি এলাকায় কেন মানুষ বসতি গড়ে তুললো? আর কীভাবেই সে সময় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যতীত এতো সুসজ্জিত একটি নগর গড়ে তোলা সম্ভব হলো? সেটি আসলেই আশ্চর্যের বিষয়। পোহ্নেপী এর কেউই এর সঠিক তথ্য জানেনা যে কীভাবে প্রাচীন মানুষেরা এতো বৃহৎ একটি নগর গড়ে তুলেছিলো। বিজ্ঞানীরা বলেন, এককটি ব্যাসাল্ট পাথরের ওজন প্রায় ৫০ টন, কোনো কোনো পাথর ২৫ ফুট উঁচু আর ১৭ ফুট চওড়া। সেগুলোকে নাকি ভেলায় করে নান মাদলে আনা হয়েছিলো।
তবে স্থানীয়দের মতে, নান মাদলের ব্যবহৃত পাথরগুলোকে কালো জাদুর মধ্যমে সেখানে একত্রিত করা হয়েছিলো। প্রত্নতত্নবিদগণও সেখানে গবেষণা চালান তবে, কীভাবে নান মাদলের নির্মাণ সামগ্রী সে সময় বহন করা হয়েছিলো তার সঠিক কোনো তথ্যই এখন পর্যন্ত নির্ধারিত হয়নি। দ্বীপে শিলা কাঠামোর আয়তন প্রায় ১৬ মিটার। বিজ্ঞানীদের মধ্যে কেউ কেউ ধারণা করেন, নান মাদল তৈরি করতে প্রায় এক হাজার শ্রমিক শতাধিক বছর সময় নিয়েছিল।
বেসাল্ট কলামগুলো থেকে তৈরি শহরের একটি অংশ ছিল পুরোহিত এবং শাসকদের জন্য; বাকি অর্ধেক ছিল প্রশাসন কেন্দ্র। সেখানে ছিলো মন্দির, সমাধি, মিলন ঘর, গণ স্নানকক্ষ কচ্ছপ, এবং বানমাছ সহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ সংবলিত পুকুর। তবে বেশিরভাগ দ্বীপপুঞ্জ আবাসিক অঞ্চল ছিলো। এরই মধ্যে কিছু জায়গা খাবার ও নারিকেল তেল উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হতো। সেখানে ডিঙি নৌকাও তৈরী হতো।
নান মাদলের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল মাদুর পাওয়েতে ৫৮ টি দ্বীপ রয়েছে। পুরো কমপ্লেক্সের কেন্দ্রস্থলটিতে রয়েছে সেখানকার শাসক নন্দৌবাস-এর রাজকীয় সমাধি, যার চারপাশে ৭ দশমিক ৫ মিটার উঁচু দেয়াল রয়েছে। নান মাদল একটি ধর্মীয় কেন্দ্র ছিল। পোহ্নেপী এর বাদশাহ-রা এখানে ধর্মচর্চা করতেন। কিন্তু তারা কীভাবে উপাসনা করতেন তার রহস্য দেয়ালভেদ করতে পারেনি। মন্দিরগুলোতে সাকাউ নামক এক প্রকার আনুষ্ঠানিক পানীয় তৈরি হতো। এখনো নাকি পোহ্নেপীর লোকেরা তাদের আচারকে পবিত্র করতে এই পানীয় ব্যবহার করে। অনেকেই এই স্থানটিতে অ্যাডভেঞ্চার করতে পছন্দ করেন
ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তালিকায়
১৯৮৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকার নান মাদলকে জাতীয় ঐতিহাসিক স্থাপনা হিসেবে ঘোষণা করে। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে নান মাদল ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটির তালিকায় স্থান পায়।
পর্যটন ব্যবস্থা
নান মাদল এখনো সর্বসাধারণের জন্য পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে প্রস্তুত নয়। কিন্তু কিছু সংখ্যক মানুষ যারা অ্যাডভেঞ্চার করতে ভালোবাসেন তারা স্ব-ব্যবস্থাপনায় নৌকায় সেখনে ভ্রমণে যান। জন সমাগম কম থাকার ফলে মনোরম নিরিবিলি পরিবেশের সঙ্গে রহস্যের গন্ধটা একটু গভীরভাবে উপলব্ধি করার সুযোগ হয়।