প্রমদতরী জাহাজ বলতে সমুদ্রের বুকে ভেসে থাকা বিশাল আকৃতির জাহাজকে বুঝায়, যেখানে বয়েছে বসবাসের উপযোগী সকল সুযোগ সুবিধা। বর্তমানে প্রমোদতরীগুলো বিলাশ বহুল ব্যয় করায় এবং প্রকৃতিকে খুব কাছথেকে উপভোগ করার জন্য প্রকৃতিপ্রেমী অনেক মানুষ রয়েছেন যারা ছুটি কাটানোর জন্য প্রমোদতরী ভ্রমনকেই বেছে নিচ্ছেন। ইঞ্জিনিয়ারিং ল্যাবের আয়োজনে আজ আমরা জানব বিশ্বের সবচেয়ে বড় কিছু প্রমোদতরী জাহাজ সম্পর্কে।
সমুদ্রের বিশালত্বে হারিয়ে গিয়ে নিজেকে চাঙা করে তুলতে কে না পছন্দ করে? তাই সমুদ্রভ্রমণকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য বিশ্বজুড়ে পর্যটন ব্যবসার সাথে জড়িত সংস্থাগুলোর প্রচেষ্টার কোনো কমতি নেই। সেই প্রচেষ্টার একটি অংশ হচ্ছে বিলাসবহুল ‘ক্রুজ শিপ’ বা প্রমোদতরী। পর্যটন খাতে প্রমোদতরীর প্রভাব যে কতদূর গড়িয়েছে তার একটি তথ্য দেয়া যাক। ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাপী ৩১ মিলিয়ন পর্যটক পেয়েছে ক্রুজ শিল্প। আর তা থেকে আয় হয় ৩৯.৬ বিলিয়ন ডলার! তাহলে চলুন জেনে নিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় ৫ প্রমোদতরী সম্পর্কে কিছু তথ্য, যেগুলোকে আপনি প্রমোদতরী না বলে ‘ভাসমান শহর’ও বলতে পারেন।
১. হারমোনি অব দ্য সিস
বর্তমান সারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও বিলাসবহুল, জাহাজের নামর্টি হচ্ছে ‘ওয়েসিস অফ দ্য সিস’। যার বাংলায় অর্থ ‘সাগরের মরূদ্যান’। এই জাহাজটি নির্মাণের শুরুতেই রয়্যাল ক্যারিবিয়ান ‘নেম দ্যাট শিপ’ নামের এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন।প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্নস্থান থেকে প্রায় ৯১ হাজার নাম সংগৃহীত হয়েছিল। এ বিপুল সংখ্যক নামের মধ্যে থেকে বাছাইয়ের মাধ্যমে অবশেষে মিশিগানের জর্জ ওয়েজারের পাঠানো ‘ওয়েসিস অব দ্যা সিজ’ নির্বাচিত হয়।
রয়্যাল ক্যারিবিয়ান ক্রুজ লিমিটেডের ওয়েসিস সিরিজের এ জাহাজটি বিশ্বের বৃহত্তম প্রমোদতরী। ‘এসটিএক্স ফ্রান্স’ কোম্পানির সেইন্ট নাজাইর শিপইয়ার্ডে এ জাহাজটি নির্মিত হয়। এর নির্মাণকাজে ব্যয় হয় ১.৩৫ বিলিয়ন ডলার। প্রমোদতরীর জগতে এ জাহাজটি সবচেয়ে নতুন। ২০১৬ সালের জুনে হারমোনি এর প্রথম সমুদ্রযাত্রা শুরু করেন। ২ লক্ষ ২৬ হাজার জিটি ভারবাহী এ জাহাজটি দৈর্ঘ্যে ৩৬২ মিটার এবং প্রস্থে ৬৬ মিটার। এ তালিকার অন্য জাহাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪৬ কিলোমিটার/ঘন্টা গতিতে চলতে সক্ষম । সর্বোচ্চ ৬,৭০০ জন যাত্রী ধারণক্ষমতা সম্পন্ন হারমোনি বর্তমানে বার্সেলোনা থেকে রোম রুটে চলাচল করছেন।
হারমোনির প্রধান আকর্ষণ সম্ভবত পুরো জাহাজকে ঘিরে এর চক্রাকার রাস্তা, যেখানে সাইকেল চালানোর ব্যবস্থা রয়েছে। এর ২৭৫০টি কক্ষের সুযোগ সুবিধা এবং ভাড়া ভেদে ৪৩টি শ্রেণী রয়েছে! এ জাহাজে আছে ভাইটালিটি স্পা, বাচ্চাদের জন্য স্প্ল্যাশওয়ে পুল, অত্যাধুনিক ওয়াটার স্লাইড এবং ড্রাই স্লাইড, ২৩টি সুইমিং পুল যার মধ্যে ১০টি উন্মুক্ত ডেকে, ২টি সার্ফিং স্পেস, পাজেল ব্রেক, বাস্তবসম্মত গেমিং স্পেস, ২০টি ডাইনিং স্পেস, একুরিয়াম থিয়েটার, ১৪০০ আসন বিশিষ্ট রয়্যাল থিয়েটার, পিং পং কোর্স, মিনি গলফ কোর্স, বাস্কেটবল কোর্ট, জিপলাইন, বায়োনিক বার যেখানে দুটি রোবট সকল প্রকার পানীয় পরিবেশন করে। তাছাড়া পুরো জাহাজটি উচ্চগতির ইন্টারনেট সুবিধাসম্পন্ন, এর করিডোরগুলো ১১ হাজারের ও অধিক চিত্রকর্মে সজ্জিত। অবকাশ যাপনের জন্য এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে?
২. সিম্ফনি অবদ্য সিস
‘সিম্ফনি অব দ্য সিস’ যেনো সমুদ্রের মধ্যে আরেকটি পৃথিবী। ভূমধ্যসাগর কিংবা ক্যারিবিয়ানে ছুটিছাটায় সর্বোচ্চ বিনোদন দিতে এই জাহাজটিতে অায়োজনের কোনো কমতি রাখেনি কর্তৃপক্ষ। ৩৬১.০১১ মিটার (১১৮৪.৪২ ফুট) লম্বা এবং ৭২.৫ মিটার (২৩৮ ফুট) উচ্চতার জাহাজটি ৬ হাজার ৬৮০ জন যাত্রী বহন করতে সক্ষম। ২০১৫ সালে ফ্রান্সে নির্মাণকাজ শুরু হয় এই জাহাজটির। নির্মাণে কাজ করেছেন ২ হাজারের বেশী শ্রমিক। নির্মানকার্যে ব্যয় হয় প্রায় ১.৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এই জাহাজের বিশেষত্ব হলো যাত্রী ধারণক্ষমতা। বিশ্বের সর্বাধিক যাত্রী ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ভ্রমণ জাহাজ হলো এই ‘সিম্ফনি অব দ্য সিস’। বিশ্বের সবচেয়ে বড় যাত্রীবাহী জেট এয়ারবাস A380 -তে সিটের সংখ্যা ৫২৫টি। তুলনা করলে বলা যায়, ‘সিম্ফনি অব দ্য সিস’ তার চেয়েও দশগুণ বেশি যাত্রী বহন করতে সক্ষম। দ্রুততার দিক হতে জাহাজটি ঘণ্টায় ২৫ কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারবে।
‘সিম্ফনি অব দ্য সিস’ এ রয়েছে মোট ১৮টি ডেক। তারমধ্যে ১৬টি ডেকে রয়েছে ২ হাজার ৭৫৯টি কেবিন। যা বর্তমানে যেকোনো জাহাজের থেকেও অনেক বেশি। জাহাজটি এতো বড় যে যাত্রীরা যাতে হারিয়ে না যান, সেজন্য তাদেরকে জিপিএস ব্যবহার করতে হবে!
দুই তলা বিশিষ্ট এই জাহাজের সিগনেচার রুমটিকে বলা হয় রয়েল লফট স্যুট। রয়েল লফট স্যুটের প্রথম তলাতে রয়েছে ১ হাজার ৬০০ স্কয়ার ফুটের একটি লিভিং স্পেস। অন্যদিকে ৮৭৪ স্কয়ার ফুটের ২য় তলাটি শহরের বড় কোনো অ্যাপার্টমেন্টের চেয়েও অনেক বেশি বড়।
যেহেতু ‘সিম্ফনি অব দ্য সিস’ একটি ভ্রমণ জাহাজ সেহেতু এখানে ছুটি কাটাতে আসা যাত্রীদের আনন্দ গ্রহণে যেনো এতোটুকু অসুবিধা না হয় তাই বিশ্বের ৮০টি দেশ হতে প্রায় ২ হাজার ২০০ জন কর্মচারী তাদের সেবায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আবার সবচেয়ে এক্সক্লুসিভ কেবিনে যারা থাকবেন তাদের সেবায় থাকবে রয়েল জেনিস উপাধির খানসামা। এরা অতিথিদের মালপত্র খুলতে ও গোছাতে অতিথিদের সহযোগিতা করবে।
ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ বা ডিনার নিয়ে অতিথি বা যাত্রীদের কোনো চিন্তা নেই। ২২টি ডাইনিং অপশন ও বার রয়েছে ‘সিম্ফনি অব দ্য সিস’ জাহাজটিতে। খাবারের মধ্যে রয়েছে হটডগ হতে শুরু করে সুশি পর্যন্ত। জাহাজটিতে খোলা হয়েছে একটি বায়োনিক বার। যেখানে রোবটরা কাস্টমারদের চাহিদা অনুযায়ী ককটেলও বানিয়ে দেবে। রয়েছে খেলার জায়গা, কমেডি ও জ্যাজ ক্লাব, বুটিক শপ, সি স্পা ও ফিটনেস সেন্টার, ইয়োথ জোন, ২৪টি সুইমিংপুল, স্পের্টস জোন, সেন্ট্রাল পার্ক এবং চিত্তবিনোদন, কেনাকাটা ও শরীরচর্চার জন্য রয়েছে সব ব্যবস্থা। মধ্যখানে অবস্থিত সেন্ট্রাল পার্কে রয়েছে ২০,০০০ এর বেশী গাছও।
৩. ওয়েসিস অব দ্য সিস
‘ওয়েসিস শব্দটির মানে ‘মরুদ্যান’। ধু-ধু মরুভূমির এক টুকরো জলাশয় কিছু গাছে ঘেরা, এই তো মরুদ্যান। তেমনি, সমুদ্রের বিস্তীর্ণ নীল জলরাশির মাঝে ওয়েসিস সিরিজের এই জাহাজটিও এক টুকরো মরুদ্যানের মতো। না, পুরো জাহাজটিতে মরুদ্যান সদৃশ কিছুই খুঁজে পাবেন না, কেবল এর উপরের ডেক বাদে। ডেকগুলো এমনভাবেই সাজানো হয়েছে যে দূর থেকে দেখলে আপনি সেটিকে মরুদ্যান ভেবে ভুল করতেও পারেন! ডেকের পৃষ্ঠটাও যে মরুভূমির ধূসর বালুর মতো দেখতে। ২ লক্ষ ২৫ হাজার জিটি ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এ জাহাজটি লম্বায় ৩৬১ মিটার এবং চওড়ায় ৬০ মিটার। জাহাজটি তৈরি করতে রয়্যাল ক্যারিবিয়ান ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানির খরচ হয়েছে ১.৪ বিলিয়ন ডলার, যা একে করেছে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে দামী প্রমোদতরী। ২০০৯ সাল থেকেই এ জাহাজটি পর্যটন ব্যবস্থার সাথে যুক্ত। সাধারণ শয়নকক্ষের পাশাপাশি ওয়েসিসে রয়েছে ঝুল-বারান্দাসহ বিলাসবহুল কক্ষ এবং ডুপ্লেক্স স্যুট। আগের দুটি প্রমোদতরীর চেয়ে এ জাহাজটিতে রয়েছে আরো বাড়তি কিছু সুযোগ সুবিধা। অ্যাকুয়া থিয়েটার, বিশাল উন্মুক্ত করিডর, সার্ফিং স্পেস, একটি কেন্দ্রীয় পার্ক, জিপলাইনের ব্যবস্থা, সুউচ্চ ওয়াটার কোস্টার রাইড, ভলিবল এবং বাস্কেটবল কোর্টসহ অসংখ্য বিনোদনের ব্যবস্থায় সমৃদ্ধ এ জাহাজটি। তাছাড়া রেস্টুরেন্ট, বার কিংবা সুইমিং পুল তো আছেই। সর্বোচ্চ ৬,২০০ জন যাত্রী ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এ জাহাজটি ঘন্টায় ৪২ কিলোমিটার পর্যন্ত যেতে পারে।
৪. কোয়ান্টাম অব দ্য সিস
এ জাহাজটি রয়্যাল ক্যারিবিয়ান ক্রুজ কোম্পানির কোয়ান্টাম সিরিজের প্রথম জাহাজ। ২০১৪ সাল থেকে সমুদ্র দাপিয়ে বেড়ানো এ জাহাজ যৌথভাবে নির্মাণ করে রয়্যাল ক্যারিবিয়ান কোম্পানি এবং মেয়ার রেফট কোম্পানি। এটি বর্তমানে চীনের সাংহাই থেকে জাপান ও কোরিয়ায় যাত্রী পরিবহন করছে।
৩৪৮ মিটার লম্বা এ জাহাজটি ওভেশন থেকে এগিয়ে গিয়েছে প্রস্থে। কোয়ান্টাম জাহাজটি ৪৯.৫ মিটার প্রশস্ত। এর ধারণক্ষমতাও ওভেশনেরই সমান, ১ লক্ষ ৬৮ হাজার জিটি। ৯৩৫ মিলিয়ন ডলার খরচে নির্মাণ করা এ জাহাজটি বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল জাহাজ ছিল এর নির্মাণের বছরে। সর্বমোট ২০০০ শয়নকক্ষে ৪ হাজার যাত্রী নিয়েই সাধারণত ভেসে বেড়ায় কোয়ান্টাম।
তবে এর সর্বোচ্চ যাত্রী ধারণক্ষমতা ৫ হাজার। ওভেশনের ১৬টি ডেক বিশিষ্ট এই জাহাজের একটি বিশেষত্ব হলো এর ভিআইপি শ্রেণীর শয়নকক্ষগুলোতে ঝুল-বারান্দা রয়েছে। তাছাড়া এতে রয়েছে দুটি আকর্ষণীয় শপিং মল। অন্যান্য সুযোগ সুবিধা ওভেশনের মতোই।
৫. ওভেশন অব দ্য সিস
৩৪৮ মিটার লম্বা এবং ৪৯ মিটার চওড়া সমুদ্রের দানব ‘ওভেশন অব দ্য সিস’ জাহাজটি ‘রয়্যাল ক্যারিবিয়ান ক্রুজ’ কোম্পানির কোয়ান্টাম সিরিজের তৃতীয় জাহাজ। ১৬টি সান বাথের ডেক, ২০৯০টি শয়নকক্ষ, তিনটি সিনেমা হল, ওয়েলপুল, শিশুদের জন্য বিশেষ পার্ক, ওয়াটার পার্ক, ক্যাসিনো, বার, রেস্টুরেন্ট, একাধিক ডিস্কো এবং শ’খানেক খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দোকান- সব মিলিয়ে জাহাজটি একটি পূর্ণাঙ্গ শহর!
২০১৬ সালের এপ্রিলে ক্যারিবিয়ান ক্রুজ কোম্পানি জাহাজটিকে সমুদ্রে ভাসায়। ১ লক্ষ ৬৮ হাজার জিটি (গ্রস টনেজ) ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এই জাহাজের সর্বোচ্চ গতি ঘন্টায় ২২ নটিক্যাল মাইল। এই কোয়ান্টাম ক্লাস প্রমোদতরীটি যেকোনো অবস্থায় সর্বোচ্চ ৪৯০০ জন যাত্রী পরিবহনে সক্ষম। ওভেশন অব দ্য সিস জাহাজে ভ্রমণের জন্য, সুযোগ সুবিধা ভেদে প্রতিদিন ব্যয় করতে হবে ২০০-১০০০ ডলার। বাংলাদেশি টাকায় ১৬ হাজার থেকে ৮৪ হাজার টাকা পর্যন্ত!
তবে একটা কথা। টাকা থাকলেই টিকিট মিলবে, তা কিন্তু মোটেই নয়।এ বিলাসবহুল বিনোদনের স্বাদ পেতে প্রায় দেড় থেকে দু’বছর আগেই বুকিং করতে হবে আপনাকে।