বাংলাদেশের ঐতিহাসিক প্রায় সাড়ে চারশত বছরের ঐতিহ্য ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে নওগাঁর কুসুম্বা মসজিদ। যা বর্তমানে পাঁচ টাকার নোটে মুদ্রিত। এটি নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলায় কুসুম্বা গ্রামে অবস্থিত। কুসুম্বা মসজিদটির পূর্ববর্তী নামছিল কালাপাহাড়।

প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী আসেন এই মসজিদটি দেখার জন্য।কুসুম্বা মসজিদটি সুলতানি আমলের একটি পুরাকীর্তি নিদর্শন। যা নওগাঁ জেলার ইতিহাস ও মুসলিম ঐতিহ্যের উজ্জল নক্ষত্র। মসজিদটি বাংলা চালা ঘরের মতো এবং পূর্ব পাশে অবস্থিত উত্তর-দক্ষিণে ঈষৎ বক্র, মসজিদ সংলগ্ন ৭৭ বিঘা বিশিষ্ট একটি বিশাল দিঘি। দিঘিটি লম্বায় প্রায় ১২০০ ফুট ও চওড়ায় প্রায় ৯০০ ফুট। গ্রামবাসী এবং মুসল্লিদের খাবার পানি, গোসল ও অযুর প্রয়োজন মেটানোর জন্য এই দিঘিটি খনন করা হয়েছিল। এই দিঘির পশ্চিম পাড়েই নির্মাণ করা হয়েছে ঐতিহাসিক কুসুম্বা মসজিদটি।

কুসুম্বা মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে ৫৮ফুট লম্বা, ৪২ ফুট চওড়ায়। চারদিকের দেওয়াল ৬ ফুট পুরু। তার উপর বাইরের অংশ পাথর দিয়ে ঢাঁকা এবং ভিতরে রয়েছে ইটের গাঁথুনি। মসজিদের সন্মুখভাগে রয়েছে ৩টি  দরজা। আকারে ২টি বড়, অন্যটি অপেক্ষাকৃত ছোট। দরজাগুলো খিলানযুক্ত মেহরাব আকৃতির। মসজিদের চার কোনায় রয়েছে ৪টি মিনার। মিনারগুলো মসজিদের দেওয়াল পর্যন্ত উঁচু ও আট কোনা বিশিষ্ট। ছাদের ওপর রয়েছে মোট ৬টি গুম্বুজ। যা দুইটি সারিতে অবস্থিত।দ্বিতীয় সারির গম্বুজগুলো আকৃতিতে একটি ছোট।

১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ৩টি গম্বুজের কিছুটা ফাটল ধরেছিল। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ব বিভাগ মসজিদটিকে সংস্কার করেন। মসজিদের ভিতরে ২টি পিলার রয়েছে। উত্তর দিকের মেহরাবের সামনে পাথরের পিলারের ওপর তৈরি করা হয়েছিল একটি দোতলা ঘর। এই ঘরটিকে বলা হতো জেনান গ্যালারি বা মহিলাদের নামাজের স্থান। এখানে মহিলারা পৃথকভাবে নামাজ আদায় করতেন।

মসজিদের ভেতর পশ্চিমের দেয়ালে রয়েছে ৩টি চমৎকার মেহরাবের ওপর ঝুলন্ত শিকল, ফুল ও লতা-পাতা কারুকার্যের সমারোহ। এ কারুকার্যগুলো খুব উন্নত মানের। দক্ষিণ দিকের মেহরাব ২টি আকারে বড়। উত্তর দিকের মেহরাবটি আকারে ছোট। মসজিদটির উত্তর-দক্ষিণ দিকে দুটি করে দরজা ছিল।

মসজিদের সন্মুখভাগে অর্থাৎ পূর্ব দিকে রয়েছে খোলা প্রাঙ্গণ ও পাথর বসানো সিঁড়ি। যা দিঘিতে গিয়ে নেমেছে। মসজিদের প্রবেশ পথের ‌একটু দূরে বাক্স আকৃতির একখণ্ড কালো পাথর দেখা যায়। এটিকে অনেকে কবর বলে মনে করেন।

লোকমুখে জানা যায় একজন কৃষক তার জমিতে হাল চাষের সময় এই পাথরটির অনুসন্ধান মেলে। সম্ভবত তার প্রচেষ্টায় পাথরটি জমি থেকে তুলে এনে রাস্তার পাশে রাখা হয়েছিল। এই পাথরের গায়ে তোগড়া হরফে আরবিতে লেখা রয়েছে, ‘আল মালেকু মা হুমম মোকারারামা আবুল মোজাফফর হোসেন শাহ বিন সৈয়দ আসরাফ আল হোসেন।‘ যার অর্থ ‘তিনি শাসক যিনি পরাক্রমশালী ও সন্মানের অধিকারী সৈয়দ আশরাফ আল হুসেনের পুত্র আবুল মোজাফর হোসেন শাহ।’ এ থেকে বোঝা যায় প্রস্তুর খণ্ডটি হুসেন শাহের স্মৃতি বিজরিত।

লোকমুখে জানা যায় সবরখান বা সোলায়মান নামে ধর্মান্তরিত এক মুসলমান মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদের দুটি শিলালিপির প্রতিষ্ঠাকাল সম্পর্কে মানুষের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। তবে মূল প্রবেশ পথে শিলালিপি থেকে প্রমাণিত হয় এই মসজিদটি ৯৬৬ হি. বা ১৫৫৮খ্রিষ্টব্দের, শের শাহের বংশধর আফগান সুলতান প্রথম গিয়াস উদ্দীন বাহাদুরের শাসনামলে ১৫৫৪-১৫৬০ সালে নির্মিত। সে হিসাবে মসজিদটির বর্তমান বয়স ৪শ’ ৫৮ বছর এর ওঅধিক।

কুসুম্বা মসজিদে ব্যবহৃত পাথর গুলো অন্য কোনও প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাব-শেষ থেকে সংগৃহীত হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন। এটি শিলালিপি পাঠের মাধ্যমে জানা যায়, সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহের আমলে তার মন্ত্রী বা প্রশাসনিক কর্মকর্তা রামন দল কর্তৃক ৯০৪ হিজরি বা ১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়। মসজিদটির নির্মাণ কাজ কোন সালে বা কখন কোন তারিখে শেষ হয়েছিল তার সঠিক নিদর্শন পাওয়া যায়নি।

পাঁচ টাকার ওপর ছবিটি দেখে অনেকেই দূর-দূরান্ত থেকে ঘুরতে আসেন এই মসজিদটিতে। বিভিন্ন পর্যটক সমালোচনা করেন, বিপুল সম্ভবনা থাকার পরও প্রয়োজনীয় নজরদারির অভাবে নওগাঁর এই ঐতিহাসিক কুসুম্বা মসজিদ আকর্ষনীয় স্পট হিসাবে গড়ে উঠছে না।

কুসম্বা মসজিদটি নওগাঁর ঐতিহাসিক স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম। এখানে প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী আসেন এবং প্রতি শুক্রবার দুই হাজারের ও অধিক লোকের সমাগম হয়ে থাকে, মুসলমানরা তাদের মানত আদায় করতে আসেন, এখানে মানত আদায়ের জন্য ৩০ টিরও অধিক চুলা রয়েছে, যা ফ্রিতে রান্না-বান্না করতে দেয়া হয়। জাস্ট পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য ১0/20 টাকা দিলেই চলে।

 মসজিদটি দেখার জন্য। দর্শনার্থীদের সুযোগ-সুবিধার জন্য অযু ও গোসলের ব্যবস্থা রয়েছে। তাছাড়াও পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা রয়েছে। দর্শনার্থীদের আরও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য এরইমধ্যে পিকনিক স্পট ও বিশ্রামাগার সহ বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক কাজ চলছে।

অবস্থান

বাংলাদেশের রাজশাহী বিভাগের নওগাঁ জেলার আত্রাই নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত এই কুসুম্বা মসজিদ, মান্দা উপজেলা থেকে ৪ মাইল উত্তর- পশ্চিমে মান্দা  নওগাঁ সড়কের পশ্চিম পার্শ্বে এ মসজিদটি অবস্থিত।

কিভাবে যাবেন?

নওগাঁ শহর থেকে প্রায় ৪০ কিঃমিঃ দূরে এ কুসুম্বা মসজিদটি অবস্থিত। নওগাঁ শহর থেকে রাজশাহী গামী বাসে করে আসতে হবে । যার ভাড়া নিবে ৪০/ ৫০ টাকা |

রাজশাহী শহর থেকে প্রায় ৪৫ কিঃমিঃ থেকে দূরে এ কুসুম্বা মসজিদ । রাজশাহী রেলগেট থেকে নওগাঁ গামী বাস ও সিএনজি করে যাওয়া যায়, যার ভাড়া নিবে ৫০/৬০ টাকা

খাবার এবং আবাসন ব্যবস্থা

নওগাঁতে জেলা পরিষদের একটি ডাকবাংলো রয়েছে। এছাড়া বেশকিছু সাধারণ মানের আবাসিক  হোটেল ও গড়ে উঠেছে নিকটবর্তী থানা পর্যায়ে। নওগাঁর দেলুয়াবাড়ী বাজারে বেশকিছু মিষ্টান্ন ভান্ডার ও রেস্তোরাঁয় সুলভ মূল্যে খাবার খেতে পারবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here